লিয়াকত হোসেন (লিংকন): ২০০৩ সালে বিএ পাশ করার পর দুই বন্ধু মিলে গাজীপুরের টঙ্গী গোয়ালিনী কনডেন্স মিল্ক ফ্যাক্টরীতে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরি নেন। সামান্য বেতনের ওই চাকরিতে দু’জনের পুষায় না। দুই বন্ধু ফিরে আসেন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা নিজ গ্রামে। এলাকায় অপর এক বন্ধুর কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার নিয়ে রফিক-উল-হাসান সুমন পৈত্রিক জমিতে মূলাচাষ করেন ।
কিন্তু অসময়ে মূলা চাষে লাভের মুখ দেখতে পাননি তিনি। তবুও তিনি নিরাশ না হয়ে পরের বছর ৭ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজির চাষ করেন। এবার সুমন দেখতে পান লাভের মুখ। এভাবে দিন দিন কৃষি খামারের প্রতি সুমনের আগ্রহ বাড়তে থাকে। ক্রমেই খামারে জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকেন। এভাবে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সমন্বিত কৃষি খামার করে সাফল্য অর্জন করেন সুমন।
শুরুর দিকে খামারের জমি ৭ বিঘা হলেও এখন প্রায় ৪০ বিঘা নিয়ে খামারটি বিস্তৃত। সুমন পাশাপাশি একটি ওষুধ কোম্পানীতে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরি নেন। পেশায় মার্কেটিং অফিসার হলেও তিনি একজন সফল কৃষি খামারী। সমন্বিত কৃষি খামার করে সফল হয়েছেন। শুধু সফলই নয়, তিনি এলাকায় বেকার যুবকদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
রফিক-উল-হাসান সুমন এ বছর জাতীয় পর্যায়ে সফল আত্মকর্মী হিসেবে ‘জাতীয় যুব পুরস্কার ২০১৮’-তে ভূষিত হয়েছেন। গত ১ নভেম্বর জাতীয় যুব দিবসে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা গ্রামে মধুমতি নদীর তীরে প্রায় ৪০ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে সুমনের সমন্বিত কৃষি খামার। যেখানে কলা, পেঁপে, লালশাক, পালংশাক, বাঁধা কপি, ওল কপি, ফুল কপি, মূলা, পটল, কচু, টমেটো, শিম, বরবটি, মরিচ, ধূন্দল, ঝিংগা, গাজর, বেগুন, পেয়ারা, আখসহ বিভিন্ন জাতের শাক-সবজি ও ফলের আবাদ এবং মৎস্য খামার রয়েছে। এ খামারের উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজি ক্রয় করতে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, নড়াইল, যশোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা আসেন।
সুমনের সফলতা দেখে উপজেলার অসংখ্য বেকার যুবক ও কৃষকেরা কৃষি খামারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। খামারে নিয়মিত ১৫/২০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এতে এলাকার বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
ফুকরা গ্রামের বিধবা সরো রানী বিশ্বাস (৫৫) বলেন, ‘আমি খামারে শ্রমিক হিসেবে সারা বছর কাজ করি। আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছি। এখন আমার সংসারে কোন অভাব-অনটন নেই। খামারে শ্রমিকের কাজ করে আমার তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।’
খামারের সুপারভাইজার মো. জালাল মোল্যা (৩৫) বলেন, ‘গাছের পুষ্টি, বৃদ্ধি ও পোকামাকড় দমনের জন্য আমরা সব সময় জৈব সার ব্যবহারের চেষ্টা করি। ফলে আমাদের এখানে উৎপাদিত শাক-সবজি সম্পূর্ণ বিষমুক্ত।’
তারাইল গ্রামের কাফু কাজী বলেন, ‘শিক্ষিত ও উদ্যোমী যুবক সুমন মোল্যা কৃষি ক্ষেতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেকার যুবকদের পথপ্রদর্শক।’
রফিক-উল-হাসান সুমন বলেন, খামারে উৎপাদিত শাক-সবজি বিক্রি করে সব খরচ বাদে বছরে তাঁর প্রায় ৮/১০ লাখ টাকা আয় হয়। পাশাপাশি তিনি গ্লে¬াব ফার্মাসিউটিক্যালস্ নামে একটি ওষুধ কোম্পানীতে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরি করছেন। সরকারি সহযোগিতা পেলে চাকরি ছেড়ে আগামীতে বড় পরিসরে একটি ডেইরি ফার্ম করতে চান তিনি। যেখান থেকে সব ধরণের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করা হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘দেশের বেকার যুবকদের সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে কৃষি কাজে উৎসাহিত করেন, তাহলে অসংখ্য বেকার যুবক নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে স্বাবলম্বী হতে পারেন।
জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর রফিক-উল-হাসান সুমন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করবেন কখনো চিন্তাও করিনি। একজন কৃষক হিসেবে জাতীয় পুরস্কারের প্রাপ্তির মাধ্যমে আমার কর্মস্পৃহা ও অনুপ্রেরণা আরো বেড়ে গেছে। আমাকে নিয়ে এলাকার লোকেরা গর্ববোধ করেন। এটাই আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া।
কাশিয়ানী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রসময় বলেন, ‘রফিক-উল-হাসান সুমন একজন সফল কৃষি খামারী। তার অনুপ্রেরণা নিয়ে যুবকরা এগিয়ে আসলে বেকার সমস্যা দূর হবে। আমরা সব সময় তাঁর পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছি। এ সহযোগিতা সব সময়ই অব্যাহত থাকবে।’